Monday 1 February 2016

পাহাড়ে চড়ার গল্প

ছোটবেলা থেকেই শুনে এসেছি পাহাড় মানুষের মনকে উঁচু করে । আর সাগর মনকে করে বড় । ধীরে ধীরে বড় হওয়ার সাথে সাথে শিখলাম পাহাড় আর সাগরের প্রভাব শুধু মানুষের মনের উপরই সীমাবদ্ধ না, ইমেজের উপরও যথেষ্ঠ প্রভাব ফেলে । মানুষকে সেলিব্রেটিও করে । পাহাড়ে চড়লেও করে আবার না চড়লেও করে । সাগরে ডুবলেও করে আবার না ডুবলেও করে । তা এই বিষয় নিয়ে মেলা যুক্তিতর্ক হতে পারে । কথার পিঠে কথা হতে পারে । যুক্তির প্রত্তুতরে কুযুক্তি আসতে পারে । তাই আজ আর সেদিকটা মাড়াচ্ছি না । আজ আমার পাহাড়ে চড়ার গল্প বলতে এসেছি, সেইদিকেই মনযোগ দেই ।

আমার ঘোরাঘুরির পার্টনার শ্যামা । ওকে বললাম , "চল পাহাড়ে উঠি" । ও বসে বসে চুল আচঁড়াচ্ছিলো । আমার কথা শুনে ওর চুল আচঁড়ানো বন্ধ হয়ে গেলো । আমার দিকে অদ্ভুত ভাবে তাকিয়ে রইলো ঝাড়া ৩০ সেকেন্ড, যেন আমি বলেছি, "চলো চাঁদে চড়ি" । ৩০ সেকেন্ড পরে জিজ্ঞেস বললো, "পাহাড়ে চড়ে কি হবে ?" । আমি বললাম পাহাড়ে চড়ে সেলিব্রেটি হবো । ও এবার খিক খিক করে গায়ে জ্বালা ধরা হাসি হাসতে লাগলো ।

- বললো, সেলিব্রাটি হতে হলে বুঝি পাহাড়ে চড়তে হয় ? অন্য কোন উপায় নেই ?
- আমি বললাম, তা আছে । ব্লগ লিখে চেষ্টা করা যায় । কিন্তু লেখার হাত খারাপ । তার উপর সেলিব্রেটি ব্লগার হতে হলে ঘুরায়ে প্যাচায়ে সবদিকে বাতাস দিতে হয় । সেইদিকে চান্স কম ।
- হুমমম, আর কোন উপায় নেই ?
- আছে । নৌকায় চড়ে সাঁতরে সাগর পাড়ি দেয়া যায় । কিন্তু ইংল্যান্ডে প্রাইভেট নৌকা ভাড়া করার মেলা খরচ, আর তাছাড়া আটলান্টিকের পানিও ঠান্ডা ।
- শ্যামা আবার খানিক্ষন গোল গোল চোখে আমার দিকে তাকিয়ে থাকার পর প্রশ্ন করলো, নৌকায় চড়ে সাঁতরে সাগর পাড়ি দেয়াটা কেমন হলো ? মিনিট দশেক পর কয়েকটা ভিডিও ক্লিপ আর খবর দেখানোর পর ব্যপারটা ধরতে পারলো ।
- খানিকক্ষন ভেবে চিন্তে জিজ্ঞেস করলো, তা কোন পাহাড়ে উঠবে বলে ঠিক করলে ? এভারেস্ট । মেলা খরচ কিন্তু । আর বেঁচে ফেরার চান্স খুবই কম ।
- আরে ধুর, এভারেস্ট কে যায় । একে মেলা খরচ । তার উপর । হিমালয় রেঞ্জের সব কটা পাহাড় নিয়ে কেলেংকারীর ছড়াছড়ি । মাউন্ট স্নোডনে চড়বো । হাজার মিটারের উপর উঁচু ।
- মোটে এক হাজার মিটার ! আর এই পাহাড়ে চড়ে তুমি হবে সেলিব্রেটি ?
- আরে বাবা পাহাড়ে কি চড়েছি নাকি এর আগে কখনো ? একলাফে কি এভারেস্ট ওঠা যায় নাকি ? ধীরে ধীরে উঠতে হবে । হাজার দিয়েই শুরু করি । পরে না হয় ধীরে ধীরে বাড়ানো যাবে ।
- তা অন্য কাউকে সাথে না একাই যাবা ? আমাদের দুজনের যা অবস্থা, ১০ কদম জোরে হাটতে গেলে হাপানি ধরে যায় । শক্ত সমর্থ দেখে কাউকে সাথে নিলে ভালো হতো । আমরা দুজনেই কাত হয়ে গেলে ইমার্জেন্সিতে ফোন দেয়ার জন্য হলেও কাউকে দরকার ।

হুমমম, উত্তম প্রস্তাব । কিছুক্ষন ভেবেচিন্তে বললাম দ্রাষ্টিকে সাথে নিলে কেমন হয় ? নিয়মিত ব্যায়াম ট্যায়াম করে, দৌড়ঝাপ করে, স্ট্যামিনাও ভালো । ওকে বলে দেখলে হয় ।
দ্রাষ্টিকে বলতেই করতেই রাজি হয়ে গেল । বললো, অনেক দিন কোথাও যাওয়া হয় না । ভালোই হয় একটু পাহাড় প্রকৃতির মাঝে ঘুরে আসতে পারলে । ঠিক করলাম করলাম পরের শনিবারই বেরিয়ে পড়বো । আমাদের ছোট্ট শহরটা থেকে স্নোডোনিয়া ন্যাশনাল পার্ক প্রায় ২৫০ মাইলের মত । চার ঘন্টার মত লাগবে ড্রাইভ করে যেতে । আমার গাড়িটা আবার কুম্ভকর্ণের মত । সারাটা বছর ঘুম পাড়িয়েই রাখি, কারন একবার জেগে উঠলেই চোঁ চোঁ করে তেল খায় । আড়াইশ মাইল যেতে আসতে প্রায় ১০০ পাউন্ডের তেল খেয়ে ফেলবে । আমাদের যে কোন ঘোরাঘুরির ক্ষেত্রে থাকার খরচটা অবশ্য একেবারেই কম । বড়সড় একটা তাঁবু আছে আমার । গাড়ির পেছনে ফেলে রওয়ানা দিলেই হয় । ব্রিটেনে হোটেল ভাড়া দিয়ে পোষানো যায় না । তাই বছর ৩ আগে থেকে ক্যাম্পিং করে থাকার অভ্যাস করে নিয়েছি । শ্যামা অবশ্য প্রথমে একটু গাঁইগুই করলেও সস্তায় ভালো লোকেশন থাকা, বারবিকিউ করে খাওয়া আর রাতে ক্যাম্পফায়ারের পাশে বসে আগুন পোহানোর অ্যাডভেঞ্চারের অভিজ্ঞতার পর এখন বেশ উৎসাহের সাথেই ক্যাম্পিং করে । পরে কোন এক পোস্টে স্কটল্যান্ডের হাইল্যান্ডসে কিংবা ওয়েল্সের পাহাড়ে তাবু পেতে থাকার অভিজ্ঞতার গল্প করবো । এই পোস্টের উদ্দেশ্য পাহাড়ে চড়ে সেলিব্রেটি হওয়ার গল্প করা ।
পরের শনিবার সকাল সকাল বের হয়ে পড়লাম । বিবিসির ওয়েদার ফোরকাস্টে ঝিরঝিরে বৃষ্টি সহ রোদেলা দিনে আশ্বাস দেয়া স্বত্তেও ভারী বর্ষনের মাঝেই প্রায় ২ ঘন্টা গাড়ি চালাতে হলো । ক্যাম্পসাইটে পৌছাতেই সকাল গড়িয়ে দুপুর । ক্যাম্পসাইটটার একদিকে পাহাড় আর আরেকদিকে টলটলে জলের লেক ।



স্নোডন মাউন্টেন রেঞ্জের একবারে গা ঘেষে সাইটটা । ক্যাম্পসাইটা মুলত ২ ভাগে ভাগ করা । এক পাশে কিছু মোঘলাই স্টাইলের বিরাট তাবু পাতা । দেখেই বোঝা যাচ্ছে তাবুগুলো সারাবছরের জন্য পাতা । লোকজন বিভিন্ন অনুষ্ঠানের জন্য ভাড়া নেয় । একটা বিয়ের অনুষ্ঠান চলছে বলে মনে হলো । অন্য পাশে আমাদের মত নিজের তাবু নিয়ে ঘুরতে আসা লোক জনের জায়গা । মাঝখান দিয়ে পাহাড় থেকে টলটলে জলের একটা ধারা এসে লেকে মিশেছে । বেশ কয়েকটা ছেলেমেয়েকে দেখলাম রাবারের ডিংগি ফুলিয়ে লেকে নামছে । আমাদের পাশের তাবুর লোকজন দেখলাম দুপুরের খাবারের জন্য বিশাল বারবিকিউর আয়োজন করেছে । পোড়া মাংসের ঝাঁঝালো গন্ধটা নাকে আসার সাথে সাথেই পেটের খিদেটাও বেশ চাগিয়ে উঠলো । তাবুটা তাড়াতাড়ি পেতে ফেললাম তিনজন মিলে । শ্যামা আর দ্রাষ্টি বসে গেল পোর্টেবল চুলায় বাসা থেকে নিয়ে রান্না করে নিয়ে আসা মুরগীর মাংস আর রুটি গরম করতে । পাচ ঘন্টা জার্নি করা ক্লান্ত ক্ষুধার্ত শরীর । অমৃতের মতই লাগলো খাওয়ারটা । অমৃতের স্বাদ কেমন তা অবশ্য জানিনা । তবে এর চেয়ে ভালো কিছু হবে বলে মনে হয় না । তাবুতে শোয়ার দুইটা কম্পার্টমেন্ট । খাওয়া শেষ করে উঠেই এয়ারবেডটা ফুলিয়ে ঢুকিয়ে দিলাম আমাদের কম্পার্টমেন্টে । এক মুহুর্ত দেরী না করে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়লাম । তাবুর ভেতর থেকে লেকের প্রায় পুরোটাই দেখা যাচ্ছে । দেখতে দেখতে চোখটা নিজ থেকেই বুজে এল । মনে মধ্যে কি যেন একটা খচ খচ করতে লাগলো ? কে যেন একটু পর পর বলতে লাগলো, "পাহাড়ে চড়তে এসে এভাবে খেয়ে দেয়ে ঘুম দেয়াটা কি ঠিক হচ্ছে ?" কিছুক্ষন পর প্রশ্নকর্তা নিজেই ক্লান্ত হয়ে কোথায় যেন কেটে পড়লো । আমিও ডুব দিলাম ঘুমের রাজ্যে ।

ঘুম ভেংগে বিছানা ছেড়ে উঠতে উঠতে প্রায় ৫ টা বেজে গেল । বাকি দুই হবু পর্বাতারোহী তখনো ঘুমোচ্ছে । আমার মত পাহাড়ে চড়ে সেলিব্রেটি হওয়ার দায় তাদের দুজনের কারোই নেই । ঘুমটাও তাই বেশ গভীর । কিছুক্ষন ডাকাডাকির পর অনিচ্ছা স্বত্তেও দুজনে উঠলো । দুজনে হাত মুখ ধুতে আসতে গেল, আর আমি এই ফাঁকে একটু চা করে নিলাম । গরম চায়ে চুমুক দিতে দিতে তিনজনে ঠিক করলাম আগামী কাল পাহাড়ে ওঠার আগে আশপাশে খানিকটা হাটাহাটি করে নেয়া উচিৎ । হাত পায়ের মাংসপেশী গুলোর একটু ব্যায়াম হওয়া দরকার । গাড়ি নিয়ে বের হয়ে পড়লাম আশপাশের এলাকাটা ঘুরে দেখার জন্য ।

ওয়েলসের পাহাড়ী এলাকার রাস্তাগুলোতে গাড়ি চালানোর একটা মজার দিক হলো জার্নিটা কখনো একঘেয়ে হয় না । কখনো দুপাশে উঠে গেছে বিশাল পাহাড় । হঠাৎ করেই আবার কখনো পাহাড় সরে গিয়ে পাশে চলে আসে লেক । কখনো বা আবার রাস্তার গাড়ির সাথে পাল্লা পাশাপাশি বয়ে যেতে থাকে খরস্রোতা পাহাড়ি নদী । এই হয়তো পাহাড়ের পকেটে জমে থাকা মেঘ এসে একপশলা বৃষ্টি ঝরিয়ে গেল । এক মিনিট পরেই হয়তো আবার দেখা গেল ঝলমলে সুর্যের আলো । রাস্তার দুধারে অসংখ্য ভেড়ার খামার । সারাদিন এরা মাথা গুজে ঘাস খাওয়া ছাড়া এদের তেমন কোন কাজ নেই । ঘাস খাবার সময় কোন নড়ন চড়ন নেই । প্রথম দেখায় মনে হয় ডামি । একটু ভালো করে তাকালে মুখের নড়াচড়াটা ধরা যায় । এদের মাঝ থেকেই মাঝে সাঝে কলম্বাসের মত অতি আগ্রহী ২/১ জন বেড়ার ফাঁফ্ফোকর দিয়ে নেমে আসে রাস্তায় ।

আমরা ন্যাশনাল ট্রাস্টের একটা কারপার্কে গাড়ি রেখে পাহাড়ি একটা নদীর পাশ ধরে ট্রেকিং শুরু করলাম । পাথুরে রাস্তা । কিছু কিছু যায়গায় শ্যাওলা পড়া । তিরিশ মিনিট এগোনের পর দেখলাম জলের ধারাটা বড় হতে হতে এখানটায় এসে বেশ বড় আকার ধারন করেছে । কায়াকিং করার সাইন দেখলাম আশপাশে কিচু । নদী এখানে কিছুটা চওড়া হলেও জলের গভীরতা খুব একটা বাড়েনি । এখানে সেখানে পাথর মাথা বের করে আছে । এর মাঝে কি করে কায়াকিং করে ঠিক বুঝতে পারলাম না । পেছনে পাহাড়ের পটভুমি, কুলকুল করে বয়ে চলা নদী আর ঘরে ফেরা পাখির শব্দ মিলে অসাধারন আবহাওয়া



তিনজনই কিছুক্ষন চুপচাপ বসে থাকলাম । মিশে যাওয়ার চেষ্টা করলাম হয়তো । কতটা যেতে পারলাম জানি না । হয়তো আরো অনেকক্ষন থাকতাম । কিন্তু পিচ্ছিল পাহাড়ি রাস্তায় অন্ধকারে ট্রেকিং করে ফেরার ভয়ে তাড়াতাড়ি উঠে ফেরার পথ ধরলাম । রাতে তাবুতে এসে হাতমুখ ধুয়ে খাওয়াদাওয়া শেষ করে একটা বই হাতে নিয়ে বিছানায় লম্বা হলাম । বই পড়তে পড়তে কখন চোখের পাতা বুজে এসেছে টের পাইনি ।

স্নোডোনিয়া

সকাল বেলা ঘুম ভাংলো পাখির কিচিরমিচির শব্দে । বাকি দুজন তখনো ঘুমাচ্ছে । আমি তাবুর বাইরে এসে ক্যাম্প্সাইটের গা ঘেষে খাড়া উঠে যাওয়া পাহাড়ের সারির দিকে তাকিয়ে থাকলাম কিচ্ছুক্ষন । বিশাল, অটল দাড়িয়ে আছে একে একে অপরের গা ঘেষে ।
ডিম ভাজি আর পাউরুটি দিয়ে নাস্তা করার পর স্নোডোনিয়ার ম্যাপ আর টুরিস্ট গাইডবুক নিয়ে বসলাম । স্নোডোনিয়া ওঠার মুলত ৬ টা পথ । তিনটা মোটামুটি সহজ । ল্যানবেরিস, মাইনারস, পিগ, রেইহ ডু , ওয়াট্কিনস এবং স্নোডন রেঞ্জারস পাথ । প্রতিটা পথই ওঠানামা মিলিয়ে প্রায় ৭-৯ মাইলের মত । সময় লাগে প্রায় ৬-৭ ঘন্টার মত । এর মাঝে ল্যানবেরিস পাথটা সবচেয়ে সহজ । মাইনারস, পিগ, রেইহ ডু মোটামুটি কঠিন । ওয়াট্কিনস এবং স্নোডন রেঞ্জারস পাথ সবচেয়ে কঠিন । মাইনারস পাথ এবং পিগ ট্য্রাক দুটোই পেনি-পাস মাউন্টেন পাস থেকে শুরু । তাই ভেবেচিন্তে ঠিক করলাম পেনি-পাসে গাড়ি পার্ক করে মাইনারস পাথ দিয়ে সামিটের উদ্দেশ্যে ওঠা শুরু করবো । নেমে আসার সময় পিগ ট্র্যাক ধরে নেমে আসবো ।

ছবির সুত্র ঃ কান্ট্রি ওয়াকিং ম্যাগাজিন ; জুন ২০১৫ এডিশন ।

মে মাস । সন্ধ্যা ৬/৭ টা পর্যন্ত দিনের আলো থাকে । আমরা সকাল ১০ঃ৩০ এর দিকে পেনি-পাসে গাড়ি পার্ক করে, দুপুরে খাওয়ার জন্য একটা করে স্যান্ডউইচ আর প্রত্যেকে ২ বোতল করে পানি নিয়ে মাইনারস পাথ দিয়ে হাটা শুরু করলাম । তাই ভেবেচিন্তে ঠিক করলাম পেনি-পাসে গাড়ি পার্ক করে মাইনারস পাথ দিয়ে সামিটের উদ্দেশ্যে ওঠা শুরু করবো । গাইড বই থেকে জানতে পারলাম ব্রিটানিয়া কপারের খনি থেকে কপার নামিয়ে আনার জন্য খনি শ্রমিকরা এই পথ ব্যবহার করতো, তাই এর নাম মাইনার'স পাথ । মাইনার'স পাথের অর্ধেকটাই প্রায় সমতল । পথে ছোটবড় মিলিয়ে তিনটে লেক পড়ে । পাহাড়ের গা বেয়ে নেমে আসা ঝরনার পানি প্রথমে নেমে আসে সবচেয়ে উপরের লেকটায়, তার থেকে আরেকটা ধারা নিয়ে মাঝেরটায়, সেটা আবার ছোট ধারায় পানি সরবরাহ করছে সবচেয়ে নিচের লেকটায় ।



দ্বিতীয় লেকটার কাছ থেকেই মাইনার’স পাথ ধীরে ধীরে খাড়া হয়ে উপরের দিকে উঠতে শুরু করলো । কোন যায়গায় এক পাথর থেকে আরেক পাথরে লাফ দিয়ে, কোথাও আবার হামাগুড়ি দিয়ে । ক্যামেরার ব্যাগটা বয়ে আনার জন্য মনে মনে নিজেকেই নিজে গালি গালাজ করতে লাগলাম । দ্রাষ্টি আমাদের প্রায় ৫০ মিটার আগে আগে চলেছে । ওকেই টার্গেট করে আমি আর শ্যামা এগিয়ে চলেছি । ৫ মিনিট পরপর দাড়াচ্ছি । পানি খাচ্ছি । দ্রাষ্টি আরো এগিয়ে যাচ্ছে দেখে আবার ওঠা শুরু করছি ।

এইভাবেই ঘন্টাখানেক ওঠার পর হঠাৎ পেছন থেকে শুনি, "নারায় তাকবীর, আল্লাহু আকবার" । এমনিতেই প্রায় হামাগুড়ি দিয়ে দিয়ে পাহাড় বেয়ে উঠছিলাম । এই স্লোগান শুনে একেবারেই ফ্ল্যাট হয়ে মাটিতে শুয়ে পড়লাম । শ্যামা দেখলাম আবার চোখ গোল গোল করে পেছনে তাকিয়ে আছে । আমি ডাক দিয়ে বললাম, “মাথা নামাও, তাড়াতাড়ি মাথা নামাও" । ও আমার অবস্থা বুঝতে পেরে হো হো করে হাসতে শুরু করলো । আমিও মাথা ঘুরিয়ে পেছনে তাকিয়ে দেখি চারজন ব্রিটিশ বাংলাদেশী ভাই আমার মতই হামাগুড়ি দিয়ে ধীরে ধীরে উঠে আসছে । চারজনের মাঝে তিনজন বেশ তান্দুরুস্ত । তারা তিনটে ছোট খাটো পাথর ধরে ঝুলে থাকার থাকার আপ্রাণ চেষ্টা করছে । যদিও কেন তা ঠিক বুঝছি না, কারণ তারা যেখানে আছে সেখানে পাহাড়ে ঢাল ১৫- ২০ ডিগ্রীর বেশি না । নিচের তিনজন হাল ছেড়ে দিয়ে ফেরত যেতে চাইছে । চার নম্বরজন খানিকটা উপরে বড়সড় একটা পাথরের উপরে বসে নিচের সঙ্গীদের মনোবল চাঙা করার জন্য নারায় তাকবীর স্লোগান দিয়ে যাচ্ছে । আমি দ্রুত ধাক্কাটা সামলে নিয়ে সোজা হয়ে দাড়ালাম । শ্যামার হাসির শব্দে পাথরের উপর বসে থাকা লোকটা কুতকুতে চোখে আমাদের দিকে তাকালো । পরিস্থিতির অনুকুলে যাবার জন্য কড়া ককনি এক্সেন্টে বললাম, “ইট’স গিভস ইউ পাওয়ার, ইনি* (*ইজন’ট ইট এর শর্ট ফর্ম) ? " । ব্রাদার সাথে সাথে বিশাল দাঁড়ি গোঁফের জংগলের ভেতর থেকে হলদেটে দাঁত বের করে হেসে জানালেন, "ইয়া ব্রাদার" । আমিও শ্যামাকে দ্রুত উঠার জন্য তাড়া দিলাম । ( পথে অবশ্য আরো বেশ কিছু ব্রাদারের সাথে মোলাকাত হয়েছিল । বাংলাদেশীদের ঘোরাঘুরি সাধারণত দল বেঁধে ফটোসেশন, শপিং আর হালাল খাবার খোঁজার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে । তাই ওয়েলসের পাহাড়ে ব্রাদারদের দল বেঁধে নারায়-তকবীর স্লোগান দিতে দিতে উঠতে দেখে বেশ অবাকই হয়েছিলাম । পরে অবশ্য দল বেঁধে সিরিয়া যাওয়ার ঢল দেখে ব্যপারটা কিছুটা বোধগম্য হয়েছিল )

ছবি ঃ প্রায় চুড়ার কাছাকাছি ।

মাইনারস পাথের খাড়া অংশটা উঠে যাওয়ার পর রাস্তাটা পিগ ট্র্যাকের সাথে মিলে যায় । এই রাস্তাই উঠে গেছে একেবারে চুড়া পর্যন্ত । রাস্তা শব্দটা আসলে এই পথের সাথে খুব একটা মানানসই না । এক পাথর থেকে আরেক পাথরে লাফ দিয়ে, কখনো আবার খাড়া ঢালের কার্নিশ বেয়ে প্রতি ৫ মিনিটে একবার বিরতি দিয়ে, পানি আর দ্রাষ্টির তাড়া খেয়ে আমরা ধীরে ধীরে উঠতে লাগলাম । পাহাড়ের প্রতিটা পকেটের আবহাওয়া পাশের পকেট থেকে ভিন্ন । এই কুয়াশা, এই মেঘ গা ঘেঁষে যাচ্ছে তো আবার এই রোদ । উপরে ওঠার সাথে সাথে চারদিকের দৃশ্য দেখে ক্লান্তিটাও ধীরে ধীরে কমে আসছে । আমি কিছুক্ষন পর পর দাড়িয়ে ছবি তুলছি । এভাবে প্রায় ঘন্টা দেড়েক উঠার পর চুড়ার প্রায় কাছাকাছি পৌছে গেলাম । তাকিয়ে দেখলাম দ্রাষ্টি আমাদের আগেই চুড়ার কাছে পৌছে একটা পাথরের উপর বসে স্যান্ডউইচ খাচ্ছে । কয়েকটা সিগাল কয়েকফিট দুরে বসে জুলজুল করে ওর খাওয়া দেখছে ? স্নোডোনিয়া সমুদ্র থেকে খুব বেশি দুরে নয়, কিন্তু এতো উপরে সিগাল দেখে বেশ অবাকই লাগলো । হঠাত খেয়াল করলাম ওর পেছনে একটা পাথরের পেছন থেকে কালো ধোঁয়া বেরোচ্ছে । কেউ আগুন লাগিয়ে দিল নাকি কিছুতে, এই ভেবে এগিয়ে যেতেই খাদের মত একটা যায়গায় টেনের লাইন নজরে এলো । কালো রঙ্গের মান্ধাতার আমাদের একটা ট্রেনের বগি থেকে হুড়মুড় করে একদল চাইনিজ টুরিষ্ট নেমে এলো এবং এসেই আইপ্যাড বের করে বিভিন্ন পোজে ছবি খিচতে লাগলো ।


ছবি : তিন মুর্তি ।



ছবি ঃ বার্ডস আই ভিউ



শ্যামা কখন যে আমার পেছনে এসে দাড়িয়েছে টের পাইনি । শ্যামার গলার বিভিন্ন রকম টোন আছে । এর মাঝে একটা হচ্ছে না বুঝেও না বোঝার ভান করে ভাবে কোন অপছন্দনীয় বিষয়ে প্রশ্ন করা ।

সেই টোনেই আমাকে জিজ্ঞেস করলো, "এই পাহাড়ে যে ট্রেনে চড়া যায়, এই ব্যপারটা কি আগে থেকে জানতে ?"
না, এই মাত্রই টের পেলাম ।
এই পাহাড়ে চড়ে আসলেই সেলিব্রেটি হতে পারবা তো ?

আমি চুপ করে দাড়িয়ে থাকলাম । শ্যামা কোন উত্তর না পেয়ে ব্যাগ থেকে স্যান্ডউইচ বের করে তাতে মনযোগ দিল । আমিও মনের কষ্ট চাপা দিয়ে চুড়ার দিকে হাটা দিলাম আর মনে মনে নিজেকে বোঝাতে থাকলাম, "এভরি ফেইলার ইজ এ ফাউন্ডেশন টু মাই ফেম ...। " মাউন্ট স্নোডনের ২০০ মিটার দুরেই স্নোডোনিয়া রেঞ্জের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ চুড়া ক্রিব-গচ । উচ্চতায় স্নোডনের চেয়ে সামান্য ছোট হলেও দুর্গমতার দিক থেকে স্নোডনের চেয়ে কয়েক কাঠি উপরে । ফেমাস হবার আর বেঁচে থাকার ইচ্ছার ইকুয়েশন মিলিয়ে ভেবে দেখলাম বেঁচে থাকলে ফেমাস হওয়া যাবে কিন্তু ফেমাস হবার লোভে এই ক্লান্ত শরীরে ক্রিব-গচে চড়তে গেলে আর ফিরতে হবে না ।


ছবি ঃ পিগ ট্র্যাক ধরে নেমে আসার পথে । 
স্যান্ডউইচটা খেতে খেতে একটা বড় পাথরের উপর বসলাম । যেদিকে যতদুর চোখ যায় ঢেউ খেলানো পাহাড়ের সারি আর ফাঁকে ফাঁকে টলটলে জলের লেক । খানিক পর পর নিচু হয়ে ভেসে থাকা মেঘের রাশি এসে ঢেকে দিচ্ছে পাহাড়ের সারি । সবুজের পটভুমিতে রৌদ্র-ছায়ার এই অসাধারন লুকোচুরি দেখার জন্য আরো কিছুক্ষন বসে থাকতে ইচ্ছে করলেও নামার জন্য উঠতে হলো । শ্যামা আর দ্রাষ্টিকে ডেকে নিচে নামার প্রস্তুতি নিলাম । তিনজনে ঠিক করলাম নামার সময় পিগ ট্র্যাক ধরে নেমে আসব ।

নেমে আসার সময়ের একটা মজার অভিজ্ঞতা দিয়ে এই লম্বা উপাখ্যানের ইতি টানি । ১১-১২ বছরের ছেলেমেয়ের ছোটখাটো একটা দল আর তাদের কয়েকজন শিক্ষিকা আমাদের পাশাপাশি নেমে আসছিল । ইউরোপীয় ছেলেমেয়ের ভিড়ে একজন মাত্র উপমহাদেশীয় মেয়ে । অন্যান্য বাচ্চারা নিজ নিজ ব্যাগ কাঁধে নিয়ে নেমে গেলেও কেবল এই মেয়েটার ব্যাগ তার টিচারের কাঁধে । তারপরও মেয়েটা একটু পরপরই থেমে যাচ্ছে, কাঁদতে শুরু করছে এবং অভিযোগ জানাচ্ছে সে আর হাঁটতে পারছে না । যেই টিচার মেয়ের ব্যাগ কাঁধে নিয়ে নামছে তিনি মেয়েটাকে বোঝাচ্ছেন, “দেখো এই পাথুরে পাহাড়ি রাস্তায় কেউ তোমাকে সাহায্য করতে আসবে না । নিজের পায়ে হেঁটেই তোমাকে নামতে হবে । যত দ্রুত তুমি নামতে পারবে, তত দ্রুত হোটেলে গিয়ে গরম গরম সুপ খেয়ে বিছানায় যেতে পারবে । “ আমাদের উপমহাদেশের লোকজন সাধারনত তীর্থযাত্রা আর সহজেই একসেসিবল টু্যরিস্ট ডেস্টিনেশনের বাইরে কোথায় খুব একটা যায় না । বাচ্চাকাচ্চা হয়ে যাওয়ার পর বাচ্চাকাচ্চার ঢালটা সামনে তুলে ধরে নিজেদের ঘরকুনো অভ্যাসের ডিফেন্ড করেন । তাদের দেখাদেখি ছেলেমেয়েও ঘরকুনো হয়েই বড় হয়ে । আমাদের প্রজন্মের তাও কপাল ভালো যে আমাদের সময়ে নিশাত মজুমদার, ওয়াসফিয়া নাজরীন, তারেক অনু, এম এ মুহিতের মত কয়েকজন জন্মেছেন । এদের অভিযানের দুঃসাহসিক গল্পই আমাদের মত ঘরকুনোদের সাহস যোগায় দরজার বাইরে পা দেয়ার ।
মামুনুর রশীদ
==========
mamun babu ২০০১ at gmail.com
হাজার মানুষের ভিড়ে আমি মানুষেরেই খুজে ফিরি